বিশ্বব্যাপী বাড়ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি। এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত কার্বন নিঃসরণকে। পরিবেশকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে দেশের ব্যাংক খাত। সাম্প্রতিক সময়ে এ খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব টেকসই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। তবে জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই প্রকল্পে অর্থায়ন কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন এ তথ্য ওঠে এসেছে।
তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সবুজ অর্থায়নে মোট বিনিয়োগ করেছে ৬ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। একই সময়ে এসব প্রতিষ্ঠান টেকসই অর্থায়নে বিনিয়োগ করেছে ১ লাখ ৫ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো টেকসই ও সবুজ অর্থায়নে বিনিয়োগ করেছে ১ লাখ ১২ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৬১ দশমিক ৮২ শতাংশ।
ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনীতিতে স্থায়িত্ব আনতে হলে টেকসই ও সবুজ অর্থায়ন খাতে বিনিয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেসব ব্যাংক নীতিমালা মেনে এ খাতে বিনিয়োগ করবে, তারাই সামনের দিনগুলোতে ভালো করবে। একইসঙ্গে টেকসই ও সবুজ অর্থায়ন খাতে বিনিয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা প্রয়োজন। কারণ আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করতে পারলে এসব খাতে আরও অগ্রগতি আসবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে সবুজ অর্থায়নে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ স্থিতি ছিল ৬ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সবুজ অর্থায়ন খাতে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ কমেছে ৩৯৪ কোটি টাকা। একই সময়ে এ খাতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ কমেছে ৭৮০ কোটি টাকার বেশি।
গত জুন শেষে টেকসই অর্থায়ন খাতে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে টেকসই অর্থায়ন খাতে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ কমেছে ৯ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা। একই সময়ে টেকসই অর্থায়ন খাতে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ কমেছে ১ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গ্রিন ব্যাংকিং কার্যক্রমকে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পুনঃঅর্থায়ন সহায়তা দেয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে টেকসই অর্থায়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেন তারা। তারা আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০৫০ সালের মধ্যে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ৫০ শতাংশ সবুজ অর্থায়নে পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩০টি ব্যাংক ও সাতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সবুজ অর্থায়নে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। অর্থাৎ তারা মোট মেয়াদি ঋণের ৫ শতাংশ সবুজ অর্থায়নে বিনিয়োগ করেছে। এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে এনসিসি ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, দ্য প্রিমিয়ার ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, দ্য হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন, এবি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক এবং মার্কেন্টাইল ব্যাংক।
আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ইডকল, আইপিডিসি ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ফাইন্যান্স, দ্য ইউএই-বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট, অগ্রণী এসএমই ফাইন্যান্সিং কোম্পানি, ইউনাইটেড ফাইন্যান্স এবং আইডিএলসি। এ ছাড়া ৩১টি ব্যাংক ও ৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের মোট ঋণের ২০ শতাংশ টেকসই অর্থায়নে বিনিয়োগ করে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে।
পরিবেশবান্ধব প্রকল্পের মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন, বর্জ্য পরিশোধনাগার বা ইটিপি নির্মাণ, পরিবেশবান্ধব ইট উৎপাদন অন্যতম। এই খাতে মোট মেয়াদি ঋণের ৫ শতাংশ ঋণ দেয়ার শর্ত রয়েছে। টেকসই ও সবুজ অর্থায়নে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করতে দুই বছর ধরে বিভিন্ন মানদণ্ডে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) টেকসই বা সাসটেইনেবল রেটিং মান প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের যথাযথ নীতিগত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে টেকসই সবুজ অর্থায়নে বিনিয়োগকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। পুনঃঅর্থায়ন সবুজ ব্যাংকিং কার্যক্রমকে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে এই খাতে বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে।
অনিয়ন্ত্রিত কার্বন নিঃসরণে বাড়ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি। বাড়ছে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, জলাবদ্ধতা ও পানি বৃদ্ধি। একই সঙ্গে মাটির লবণাক্ততা বাড়ছে। ঝুঁকিগুলোকে শনাক্ত করে তা বন্ধে শুরু হয়েছে নানামুখী কার্যক্রম। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন ব্যাংক। কার্বন নিঃসরণ কমাতে পরিবেশবান্ধব টেকসই প্রকল্পে ব্যাংকগুলো অর্থায়ন করছে। সবুজ ও টেকসই অর্থায়নের লক্ষ্য বেঁধে দেয় আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এসব খাতে অর্থায়নে নজর বাড়াচ্ছে।