এপ্রিল ২৫, ২০২৪

বিশ্বমানচিত্রে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয়। একটি স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্বের অন্যতম প্রতীক হলো নিজস্ব মুদ্রা। ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের নিজস্ব ১ ও ১০০ টাকার ব্যাংক নোটের প্রচলন হয়। ২০২১ সাল থেকে দেশে ৪ মার্চ টাকা দিবস পালন করা হয়। আজ সেই কাঙ্ক্ষিত ৪ মার্চ।

তবে এবারের টাকা দিবস পালনের আগেই ক্যাশলেসের দিকে কিছুটা অগ্রসর হয়েছে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে নগদ টাকার প্রচলন কমাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এখন নগদ টাকার ব্যবহার কমেছে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তব্যাংকিং লেনদেনের সুবিধার্থে নিয়ে এসেছে ‘বিনিময়’ নামের অ্যাপ। একইসঙ্গে সম্প্রতি ব্যাংক পাড়া খ্যাত রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় পরীক্ষামূলক ক্যাশলেস বাংলাদেশের ঘোষণা এসেছে। এ সময় ১ হাজার ২০০ মার্চেন্টকে বাংলা কিউআর কোড বিতরণ করা হয়।

তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিকভাবে রাজধানীর মতিঝিলের ফুটপাতের ফল বিক্রেতা, চা দোকান, মুচি-মুদি ও হোটেলসহ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মার্চেন্ট ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই কিউআর কোড এখন আর কোনো কাজে আসছে না। কিউআর কোড ব্যবহারে অনীহা দেখা দিয়েছে ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের মধ্যে। ব্যবসায়ীদের হিসাব খুলে দেওয়া হলেও লেনদেনের অবস্থা একেবারেই নগণ্য। বেশিরভাগ ক্রেতাই কিউআর কোডের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করছেন না এ ছাড়া আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকেট তদারকি বা প্রথম দিনের মতো প্রচারণাও তেমন লক্ষ করা যাচ্ছে না। ক্যাশলেস বাংলাদেশ গড়ার প্রচরণার ব্যানার মতিঝিলের শাপলা ফুলের দেয়ালে ঝুলছে। এছাড়া দোকানে দেওয়া বাংলা কিউআর কোডগুলো দোকানের ভিতরে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মুদ্রার নাম রাখা হয়েছে টাকা। বিশ্বের কয়েকটি দেশের মুদ্রার নাম একই ধরনের। তবে বাংলাদেশের মুদ্রা হিসেবে টাকা নামটি স্বতন্ত্র। ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ প্রকাশিত দুটি ব্যাংক নোট ভারতের সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে ছাপানো হয়। ১ টাকার নকশায় বাংলাদেশের মানচিত্র ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কথাটি স্থান পায় এবং তাতে স্বাক্ষর করেছিলেন সে সময়ের অর্থসচিব কে এ জামান। অন্যদিকে ১০০ টাকার নকশায় দেখা যায় বাংলাদেশের মানচিত্র ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি এবং তাতে লেখা থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১০০ টাকার ব্যাংক নোটটি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম গভর্নর এ এন হামিদ উল্ল্যাহ্ স্বাক্ষরিত।

টাকা ব্যবহারে সচেতনতা বাড়ানোই টাকা দিবস পালনের মূল লক্ষ্য। টাকাকে কেন্দ্র করেই দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। তবে টাকা যত্নের সঙ্গে ব্যবহারে আমরা ততটা সচেতন নই। যার ফলে ব্যাংক নোট দ্রুত পুরোনো হয়ে যায় এবং স্থায়িত্ব যায় কমে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে ছাপানো টাকা ও কয়েন মিলে রয়েছে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক নোট ২ লাখ ৯০ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। আর সরকারের নোট ও কয়েন মিলে রয়েছে ১ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। তবে দেশে ব্রড মানির পরিমাণ ১৭ লাখ ৫৭ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা।

চাইলে কি নোট ছাপানো যায়?

বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলেই টাকা ছাপাতে পারে না। এর সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, সেগুলো মেনেই কাজ করতে হয়। পুরো বিষয়টি নির্ভর করে অর্থনীতির ওপর। বাজারে অর্থের প্রবাহ বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। এতে দ্রব্যমূল্য বেড়ে বাড়িয়ে দেবে জীবনযাত্রার খরচ। এ কারণে অর্থনীতির স্বার্থেই ভারসাম্য রাখতে হয়। তবে পুড়িয়ে ফেলা ব্যবহার অযোগ্য নোট ও বাজারে অর্থের প্রবাহের বিষয়টি দেখেই নতুন নোট আনা হয়। অনেক সময় বিশেষ পরিস্থিতিতে টাকা ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আবার ছিঁড়ে যাওয়া, পুড়ে নষ্ট হওয়া বা রি-ইস্যু করা যায় না এমন নোটগুলো ব্যাংকিং চ্যানেলে মার্কেট থেকে তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কয়েক হাজার কোটি টাকা এভাবে তুলে নেওয়া হয়। এ ঘাটতি পূরণেও নতুন নোট সরবরাহের প্রয়োজন পড়ে।

সরকারের ট্রেজারি বিল, বণ্ড ও ডলারের বিপরীতে বাজারে টাকা ছাড়তে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকার যদি বিদেশি ঋণ না পায় তবে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে ট্রেজারি বিল বা বণ্ড ছাড়ে। আর এসব বিল বণ্ডের বিনিময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেয়। এতে যদি ব্যাংকে তারল্যের সংকট তৈরি হয় তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব বিল বা বণ্ডের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে টাকা দিয়ে থাকবে। আবার কোন কোন সময় ব্যাংকে তারল্য সংকটের কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ পায় না সরকার। এসময় বিল ও বণ্ডের বিপরীতে ডিভলবিং ফান্ড (নতুন টাকা ছাপিয়ে) থেকে সরকারকে ঋণ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

জানা যায়, প্রতি বছর নতুন টাকা ছাপাতে সরকারের খরচ হয় সর্বনিম্ন ৫০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা। কাগজের নোট নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ ইচ্ছামতো ভাঁজ করা। আবার অনেকে মাটির ব্যাংক কিংবা গাঁটিতে টাকা রাখেন গুঁটিয়ে। এতে কমে টাকার স্থায়িত্ব। এছাড়া ভেজা হাতে টাকা লেনদেন করা, মুখের লালা লাগিয়ে টাকা গোনা, কলম দিয়ে লেখা প্রভৃতি কারণে টাকা দ্রুত নষ্ট হয়। এ কারণে প্রতিবছরই বাংলাদেশ ব্যাংক নষ্ট নোটগুলো বাজার থেকে তুলে নিয়ে তার বিপরিতে নতুন টাকা বাজারে ছাড়েন।

তথ্য মতে, এক হাজার টাকার নোট ছাপাতে ৫ টাকা ও ৫০০ টাকার নোট ছাপানোয় খরচ পড়ে ৪ টাকা ৭০ পয়সা। ২০০ টাকার নোটে তিন টাকা ২০ পয়সা, ১০০ টাকার নোটে ৪ টাকা খরচ হয়। এছাড়া ১০, ২০ ও ৫০ টাকার সবগুলো নোট তৈরিতে দেড় টাকা খরচ পড়ে। আর ৫ ও ২ টাকার নোট ছাপাতে খরচ পড়ে ১ টাকা ৪০ পয়সা। সবচেয়ে বেশি খরচ পড়ে কয়েন তৈরিতে। প্রতিটি কয়েন তৈরিতে সেই মানের প্রায় সমান সমান টাকা খরচ পড়ে যায়। তবে কয়েনে বেশি অর্থ খরচ পড়লেও টেকসই বেশি। এসব নোট ছাপাতে বছরে বিপুল অংকের অর্থ খরচ হয়। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ক্যাশলেসের দিকে এগোতে চায়।

 

 

 

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *