দেশে ধনী-দরিদ্রের আয় বৈষম্য আরও বেড়েছে। সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবারের হাতে জাতীয় আয়ের ৩০ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ পরিবারের আয় মাত্র শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য রয়েছে। গতকাল বুধবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। ২০১৬ সালে করা বিবিএসের আগের জরিপে এ হার ছিল যথাক্রমে ২৭ দশমিক ৮২ এবং শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ।
প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, বৈষম্য দারিদ্র্যের চেয়েও মারাত্মক সমস্যা। কারণ, দারিদ্র্য কমছে। এক সময় হয়তো আরও কমবে। তবে বৈষম্য কোনোদিন হয়তো শেষ হবে না।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান উপস্থিত ছিলেন না। ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছেন তিনি। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন, পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. কাউসার আহাম্মদ, বিবিএসের মহাপরিচালক মিজানুর রহমান। জরিপের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন বিবিএসের উপপরিচালক এবং খানার আয় ও ব্যয় জরিপ প্রকল্পের পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ।
দারিদ্র্য দূর করার উদ্দেশ্যে নেওয়া বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে তথ্য-উপাত্ত সরবরাহের উদ্দেশ্যে এ জরিপ পরিচালনা করা হয়। গত এপ্রিলে জরিপের প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশ থেকে বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবচেয়ে ধনীদের মধ্যে শহর-গ্রামের বৈষম্যও রয়েছে। শহরের ৫ শতাংশ সবচেয়ে ধনী পরিবারের আয় ৩৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। গ্রামের ধনীদের ক্ষেত্রে ২৪ দশমিক ২২ শতাংশ। আগের জরিপেও এই ব্যবধান ছিল। তবে নতুন জরিপে দেখা যায়, ব্যবধান আরও বেড়েছে। ২০১৬ সালের জরিপে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবারের আয় ছিল ২৭ দশমিক ৮২ শতাংশ। তখন শহরের এ ধরনের পরিবারের আয় ছিল ৩২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ এবং গ্রামের ধনী পরিবারগুলোর আয় ছিল ২৪ দশমিক ১৯ শতাংশ।
বৈষম্য পরিমাপ করা হয় জিনি সহগের মানের মাধ্যমে। জিনি সহগ শূন্য (০) মান অর্থ সম্পূর্ণ সমতা বা বৈষম্যহীনতা প্রকাশ করে। সহগ যত বাড়ে ততই তা অসমতা প্রকাশ করে থাকে। জরিপ অনুযায়ী ২০২২ সালে জিনি সহগ আগের চেয়ে আরও বেড়েছে। জিনি সহগ মান শূন্য দশমিক ৪৯৯, যা আগের জরিপে ছিল শূন্য দশমিক ৪৮২ এবং ২০১০ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৫৮। অর্থাৎ ১২ বছর ধরে দেশে বৈষম্য বাড়ছেই। আয় বৈষম্যের পাশাপাশি ভোগেও বৈষম্য বেড়েছে গত ছয় বছরে। ২০২২ সাল শেষে ভোগ-সম্পর্কিত জিনি সহগ শূন্য দশিমক ৩৩৪। বিবিএস-এর উপাত্ত অনুযায়ী, এ সহগ ২০১৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৩২৪ এবং ২০১০ সালে ছিল শূন্য দশিমক ৩২১। অর্থাৎ ভোগ বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ছয় বছরের ব্যবধানে দেশে দারিদ্র্য কমেছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশের মোট জনংখ্যার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ এখন দরিদ্র। ২০১৬ সালে পরিচালিত জরিপে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। একইভাবে অতিদারিদ্র্যও কমেছে। নতুন জরিপ অনুযায়ী, অতিদারিদ্র্যের হার এখন ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, যা আগের জরিপে ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে অতিদারিদ্র্য কমেছে ৭ দশিমক ৩ শতাংশ।
পরিবার বা খানা এবং মাথাপিছু আয় হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। জরিপ অনুযায়ী পরিবারপ্রতি মাসিক আয় এখন ৩২ হাজার ৪২২ টাকা, যা আগের জরিপে ছিল ১৫ হাজার ৯৮৮ টাকা। আয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবারে ব্যয়ও বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। পরিবারপ্রতি মাসিক ব্যয় এখন ৩১ হাজার ৫০০ টাকা, যা ২০১৬ সালের আগের জরিপে ছিল ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা। ব্যাক্তির মাথাপিছু মাসিক আয় এখন সাত হাজার ৬১৪ টাকা, আগে যা ছিল ছয় হাজার ৯১ টাকা। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে মাথাপিছু আয় বেড়েছে এক হাজার ৫২৩ টাকা।