স্বাধীনতার পর দেশের সবচেয়ে বড় অর্জন দেশের গৌরব আর সক্ষমতার প্রতীক পদ্মা সেতু, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রো যোগাযোগে আশা জাগানিয়া মেট্রোরেলসহ এমন আরও অনেক বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের সফল সমাপ্তির মাধ্যমে বছরজুড়ে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে কোটি বাঙলির মুখে হাঁসি ফুটিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। আর বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা রেকর্ড গড়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে নেওয়ার মূল কারিগর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
তবে করোনার ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর মধ্যেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আর নিষেধাজ্ঞা-পাল্টা নিষেধাজ্ঞায় বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার ঢেউ লেগেছে বাংলাদেশেও। এ নিয়ে সরকার বিচলিত না হলেও সতর্কভাবে মোকাবিলা করার ছক কষতে হচ্ছে। এতে কিছুটা হলেও কমেছে অগ্রযাত্রার গতি। তবে সংকট কাটিয়ে ছন্দ ফিরে পেতে চ্যালেঞ্জ রয়েছে সরকারেরও।
পদ্মা সেতু
দুর্নীতির মিথ্যা অজুহাত তুলে যখন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে থেকে সরে আসে তখন অনিশ্চয়তার কালো মেঘ গ্রাস করে প্রকল্প বাস্তবায়নে। পুরো দেশ যখন হতাশ, তখন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ঘোষণা দিলেন, নিজস্ব অর্থায়নেই হবে পদ্মা সেতু। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করা সম্ভব, তা কেউ-ই তখন বিশ্বাস করেননি। কিন্তু একজন শেখ হাসিনা করে দেখিয়েছেন, স্বপ্ন বাস্তবায়নও করেছেন। তার ক্যারিশম্যাটিক ও দূরদর্শী লিডারশীপের মজবুত ভিত প্রমাণ আরও একবার দেখিয়েছেন।
গত ২৫ জুন উদ্বোধন করা হয় পদ্মা সেতু। পরের দিন সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পদ্মা সেতু বাঙালির ইতিহাসে একটি মাইলফলক। অর্থনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি এই সেতু বাঙালির জীবনের একটি বড় অর্জন। এই সেতুর সাথে মিশে আছে ১৭ কোটি বাঙালির সুখ-দুঃখ আর আর্থ-সামাজিক মুক্তির সোপান।
স্বাধীনতার মহানায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছেন বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন ‘স্বাধীনতা’। আর স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও নিজেদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা দেখানোর মতে দুঃসাধ্য কারও ছিল না। নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় বাজেটের প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বিশ্বকে অর্থনৈতিক সক্ষমতা দেখানোর সেই দুঃসাধ্য দেখালেন বঙ্গবন্ধুরকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পদ্মা সেতু এখন বাঙালির কাছে এক গৌরবোজ্জ্বল সোনালী অহংকার। সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি শেখ হাসিনা সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প। এ প্রকল্পের সাথে মিশে ছিল বাঙালির অস্তিত্ব, টিকে থাকার সংগ্রাম।
সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় স্থাপনা পদ্মা সেতু। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দ্বিতল এ সেতুর এক অংশ পদ্মা নদীর মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত এবং অপর অংশ নদীর আকে পাড় শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে যুক্ত। একইসঙ্গে ট্রেন ও গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে এ সেতুতে। চার লেন বিশিষ্ট ৭২ ফুট প্রস্থের এ সেতুর নিচতলায় রয়েছে রেল লাইন। এর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।
বঙ্গবন্ধু টানেল
আওয়ামী লীগ সরকারের বড় অর্জনগুলোর মধ্যে আরও একটি প্রকল্পের সফল সমাপ্তি দেখছে বিশ্ব। বাংলাদেশে তো বটেই, পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় নেই নদীর তলদেশে টানেল। সেদিক দিয়ে বাংলাদেশই প্রথম দেশ হিসেবে রেকর্ড গড়লো।
এরই মধ্যে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের একটি টিউব গত ২৬ নভেম্বর উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুরো টানেল জানুয়ারিতে উদ্বোধন করা হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। টানেলের অভ্যন্তরে ৯৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এখনও বাকি রয়েছে ৭ শতাংশ কাজ।
চীনের কারিগরি সহায়তায় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি। চীনের এক্সিম ব্যাংক এই প্রকল্পের জন্য ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ঋণ দেয়। অবশিষ্ট টাকার জোগান দেয় বাংলাদেশ সরকার।
মেট্রোরেল
রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসার পরিকল্পনায় তরুণ প্রজন্মের আশা জাগানিয়া প্রকল্প মেট্রোরেল এখন দৃশ্যমান। ২৮ ডিসেম্বর ঢাকা নগরীতে বহুল আকাঙ্ক্ষিত নতুন এ গণপরিবহন ছুটতে শুরু করলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেলের উদ্বোধন করেন। তিনি প্রথম যাত্রী হিসেবে টিকিট কেটে মেট্রোরেলে ভ্রমণ করেন। সরকারের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় আরও একটি মাইলফলক ছুঁয়েছে এই মেট্রোরেল।
সাধারণের চলাচলের জন্য বৈদ্যুতিক এ ট্রেন চলাচল শুরু করবে ২৯ ডিসেম্বর। প্রথম দিকে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার পথে ছুটবে মেট্রোরেল। জাপান সরকারের অর্থায়নে ঢাকাবাসীর স্বপ্নের মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি ডিএমটিসিএল।
গবেষণা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে মেট্রোরেল নির্মাণে জাপানের সঙ্গে ঋণচুক্তি করে সরকার। পরের বছর প্রকল্পের বিস্তারিত নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। পরীক্ষামূলক যাত্রায় উত্তরা উত্তর স্টেশনে ফিরে আসে মেট্রোরেল। এরপর ধাপে ধাপে কাজ এগিয়েছে অগ্রাধিকারভিত্তিক এ প্রকল্পের; বাড়ানো হয়েছে এর রুটও।
রুট বাড়ানো ও ব্যয় বাড়ার আগে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল স্থাপনে চলমান এ প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এরপর কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল এগিয়ে নেওয়ায় মোট ব্যয় বেড়ে হয় প্রায় ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকায়।
একশত সেতু
পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনার সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ। একই সাথে শত সেতু উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে যোগাযোগ খাতে বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে এখন পর্যন্ত এই খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে আওয়ামী লীগ। তার অংশ হিসেবেই গত ৭ নভেম্বর একযোগে একশটি সড়ক সেতুর উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেতুগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৫টি, সিলেট বিভাগে ১৭, বরিশাল বিভাগে ১৪, ময়মনসিংহে ছয়, গোপালগঞ্জ, রাজশাহী ও রংপুরে পাঁচটি করে, ঢাকায় দুটি এবং কুমিল্লায় একটি রয়েছে। সরকার ৮৭৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে এসব সেতু নির্মাণ করেছে।
শত মহাসড়ক
শত সেতুর মতোই দেশের ৫০টি জেলায় ১০০টি জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা মহাসড়ক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব মহাসড়কের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২ হাজার ২১ কিলোমিটার। ২১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এসব মহাসড়ক উদ্বোধন করেন তিনি। ২০২১ কিলোমিটার মহাসড়কের মধ্যে ২০৬ দশমিক ৫৪ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, ৬২১ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং ১১৯৩ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার জেলা মহাসড়ক। এসব মহাসড়ক নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা।
এ ছাড়া ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (এমআরটি লাইন), এলিভেটেড এক্সপ্রেস, রিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কে পায়রা নদীর ওপর পায়রা সেতু (লেবুখালী সেতু) নির্মাণ, নড়াইলের মধুমতি সেতুর ওপর নির্মিত মধুমতি সেতু বাস্তবায়নসহ অসংখ্য উন্নয়নমূলক কাজের সফল বাস্তবায়ন ঘটিয়ে এসব এলাকার মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা আমূল পরিবর্তন এনেছে সরকার।
আশ্রয়ণ প্রকল্পে অভূতপূর্ব মানবিক কর্মকাণ্ড
শুধু উন্নয়ন পরিক্রমা নয়, গৃহহীন-ভূমিহীন মানুষ যাতে নিজের ঘর পায়, থাকার জায়গা হয়; সেজন্য অভূতপূর্ব যে মানবিক কর্মকাণ্ড জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুরু করেছিলেন, ক্ষমতায় এসে তা বাস্তবায়নে রূপ দিয়েছেন তারই কন্যা শেখ হাসিনা।
এ বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের দ্বিতীয় ধাপের আওতায় ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে আরও ২৬ হাজার ২২৯টি জমিসহ ঘর হস্তান্তর করেছেন। এর মাধ্যমে আপন নীড় পেয়েছে ৪৯২টি উপজেলার এক লাখ ৩১ হাজার ৬৪৫ জন মানুষ।
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ে দেশব্যাপী মোট ৬৭ হাজার ৮০০টি ঘর দেওয়া হচ্ছে। এই ৬৭ হাজার ৮০০ ঘরের মধ্যে ২০২২ সালের ২৬ এপ্রিল ৩২ হাজার ৯০৪টি ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে এবং বাকি আট হাজার ৬৬৭টি ঘর নির্মাণাধীন রয়েছে ।
প্রকল্পের আওতায় ২০২১-২২ পর্যন্ত এক লাখ ৮৫ হাজার ১২৯টি বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
প্রথম পর্যায়ে ২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি, ৬৩ হাজার ৯৯৯ গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবার তাদের মাথার ওপর ছাদ পায়। আর গত বছরের ২০ জুন আশ্রয়ণ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫৩ হাজার ৩৩০টি পরিবার ঘর পায়। আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৭ থেকে মোট পাঁচ লাখ নয় হাজার ৩৭০টি পরিবারের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
উন্নয়ন আর জনবান্ধব মানবিক কর্মকাণ্ডে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানীমুখী শিল্পায়ন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাক শিল্প, ওষুধ শিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচককে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দরসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহ এগিয়ে যাচ্ছে।
তবে এসব এগিয়ে যাওয়ার অগ্রযাত্রায় হঠাৎই বিদায়ী বছরের বড় ধাক্কা খায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আর নিষেধাজ্ঞা-পাল্টা নিষেধাজ্ঞায় বিশ্বব্যাপী সৃষ্টি হয় অর্থনৈতিক মন্দা। সেই মন্দার ঢেউ আছড়ে পড়ে বাংলাদেশেও। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ এই ধাক্কায় টালমাটাল হলেও, এখনও বাংলাদেশ মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থা রাখতে পেরেছে। যদিও এরই মাঝে ডলার সংকটে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশও আছে। বেড়েছে ভোগ্যপণ্যের দাম। ক্রয়ক্ষমতা কমেছে মানুষের। ভালো যাচ্ছে না ব্যবসা-বাণিজ্য। এ নিয়ে বড় চ্যালেঞ্জে পড়েছে সরকার। সংকট উত্তরণে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি মিতব্যয়ী হওয়ার অনুরোধ এসেছে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার কাছ থেকে। ২০২২ বিদায় দিয়ে আসছে ২০২৩ সালে সংকট কাটিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ।