এপ্রিল ১৯, ২০২৪

শুরুতেই একটি কথা মনে পড়ে গেল – The law is created for the rich and the punishment is for the poor. পুঁজিবাজারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আইন প্রতারকের জন্য তৈরি এবং শাস্তি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য। বিদ্যমান আইন পুঁজিবাজারে কারসাজি রোধের জন্য মোটেই যথেষ্ট ও যথোপযুক্ত নয়।

ধরুন, XYZ পুঁজিবাজারে কারসাজি করে উপার্জন করল ৫০ কোটি টাকা আর অর্থদণ্ড করা হলো ২-৫ কোটি টাকা। এটা কোনভাবেই কারসাজি রোধে ভূমিকা পালন করবে না। বরং উৎসাহ প্রদান ছাড়া আর কিছু নয়।

গভীর বিশ্লেষণে দেখা যায়, কারসাজির ফাঁদে পড়ে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত হন আমাদের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। ২০১০ মহাধস পরবর্তী আজ অবধি মুষ্টিমেয় ছাড়া অধিকাংশ বিনিয়োগকারী পরিবারসহ ঈদ আনন্দ করতে পেরেছে কিনা সন্দেহ আছে। অনেকেই পুঁজি হারিয়ে হয়েছেন সর্বস্বান্ত। বেছে নিয়েছেন আত্মহত্যার পথ এবং চিরতরে হারিয়ে গেছে এ বাজার থেকে।

আমার মতে, কারসাজিকারীদের শাস্তি হওয়া উচিত অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী। লঘু অপরাধের জন্য লঘুদণ্ড, গুরু অপরাধের জন্য গুরুদণ্ড। কারসাজি প্রতিরোধের জন্য স্ট্রং মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে। এমন জালিয়াতি যা আগে থেকে পরিকল্পিত এবং যেখানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রতারক চক্র প্রতারণা করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে কাজ করছে৷ মোদ্দাকথা, শুরুতেই রণেভঙ্গ দিতে হবে। উন্নত বিশ্বের পুঁজিবাজারের মত কারসাজি রোধে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে হবে।

সম্যক পরিচিত

Fraud Triangle বা জালিয়াতি ত্রিভুজ মডেল প্রায়শই ব্যবহৃত হয় ব্যাখ্যার জন্য। কারণ আইন সম্পর্কে জ্ঞাত/মেনে চলা লোকেরা প্রতারণা করে। এই মডেল অনুসারে প্রতারণা করার জন্য তিনটি কারণ থাকতে হবে। প্রথমত, চাপ (যেমন আর্থিক প্রয়োজন, সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন/বিব্রত হওয়া এবং মর্যাদা হারানো)। দ্বিতীয়টি, সুযোগ (চিহ্নিত বা শনাক্তকরণের কম ঝুঁকি অনুভূত হওয়া)। তৃতীয়টি, যৌক্তিকতা (কৃত আচরণ গ্রহণযোগ্য বা ন্যায়সঙ্গত মনে করে দোষীবোধ এড়ানোর প্রবল ক্ষমতা)। আমার মতে, আমাদের পুঁজিবাজারে সুযোগ এবং যৌক্তিকতা কারসাজিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

কারসাজি রোধে প্রতিরোধ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ-

কারসাজি রোধে সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কিছু কার্যকরী, সময়পযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সেইসাথে বিদ্যমান আইনের সংস্কার, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের কাছে একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজার গঠনের প্রচেষ্টা দৃশ্যমান হতে হবে, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বলাবাহুল্য বর্তমানে বিএসইসি পুঁজিবাজার উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পুঁজিবাজার উন্নয়ন এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বিবেচনাযোগ্য।

প্রথমত, কারসাজি/প্রতারণার বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে নিজেদের দায়ভার হতে রক্ষা করার জন্য বিনিয়োগকারীদের শিক্ষিত করার কোন বিকল্প নেই। পঞ্জি স্কিম, অগ্রিম ফি স্কিম, পিচের পিছনে কোনও পণ্য ছাড়াই প্রতারণার প্রস্তাব এবং পাম্প এবং ডাম্প স্কিম ইত্যাদি সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এছাড়াও বিভিন্ন ইভেন্টের মাধ্যম কীভাবে কেলেঙ্কারির শিকার হওয়া এড়ানো যায় সে সম্পর্কে সিনিয়রদের পরামর্শ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বিনিয়োগ সচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, জালিয়াতি এবং অন্যান্য আইন লঙ্ঘন প্রতিরোধ এবং সনাক্ত করার জন্য প্রতিষ্ঠানসমূহের নিজস্ব দৃঢ় সম্মতি ব্যবস্থা রয়েছে। এসব নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত নিয়ন্ত্রক তদারকি পরিচালনা এবং কঠোরভাবে সিকিউরিটিজ জালিয়াতির বিচার করতে হবে অপরাধী প্রসিকিউটরদের সাথে নিয়ে একত্রে, মিলিতভাবে ।

কারসাজিকারীদের সম্মুখে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে যে প্রচলিত আইনে সনাক্তকরণ এবং শাস্তির উচ্চ ঝুঁকি বিদ্যমান। অর্থাৎ কারসাজিরা যখন কোন কারসাজি করার সিদ্ধান্ত নেবে, তখন তাদের অবশ্যই এর ভবিষ্যৎ প্রভাবগুলি মনে রাখতে হবে। এই কারণেই অপরাধবিদরা বলছেন যে, “হোয়াইট কলার অপরাধী আসামীদের গ্রেফতারকৃত এবং হাতকড়া পরা প্রেস ফটো একটি প্রতিরোধক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।” ইনসাইডার ট্রেডিং, আর্থিক প্রতিবেদন এবং অন্যান্য লঙ্ঘনের সাথে জড়িত সিভিল এনফোর্সমেন্ট কেইসগুলিও অবিশ্বাস্যভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে বার্তাটি প্রেরণ করবে তা হল জালিয়াতি সনাক্ত করা হবে এবং অপরাধী যেই হোক না কেন সর্বোচ্চ বিচার করা হবে। কারসাজিকারীরা যখন তার সনাক্তকরণের ঝুঁকি বিবেচনা করবে তখন যেন ভবিষ্যৎ কঠোর পরিণতির একটি স্থায়ী ছাপ দৃশ্যত দেখতে পায়। সুবিধাবাদী” যারা নিজেদেরকে উপকৃত করার অবস্থানে অধিষ্ঠিত পদ-পদবী, অর্থ, সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার বলে।

যদিও তারা জালিয়াতির সাথে জড়িত হওয়ার সুযোগ খোঁজেনি তথাপিও বিভিন্ন ধরনের কারসাজি এমন লোকেদের দ্বারা সংঘটিত হয়। সম্মান এবং কর্তৃত্বের অবস্থানে থাকতে পারে এমন লোক যারা হয়তো বস্তুগত অ-পাবলিক তথ্য খোঁজেননি, বরং তাদের অবস্থানের মাধ্যমে তা দখলে নিয়ে এসেছেন, এবং সুবিধাবাদী হয়ে সেই তথ্য বাণিজ্যে ব্যবহার করেছেন। এসমস্ত ব্যক্তিদের অবশ্যই তাদের নিজস্ব সংস্থার অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ দ্বারা সনাক্তকরণের একটি বিশ্বাসযোগ্য ঝুঁকি এবং গুরুতর অনুমোদনের ঝুঁকির সম্মুখীন হওয়ার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। প্রতিষ্ঠানসমূহের অবশ্যই অভ্যন্তরীণ তত্ত্বাবধান, সম্মতি এবং নিরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ এবং অ-সম্মতি মোকাবেলার জন্য একটি ব্যবস্থা থাকতে হবে যা কারসাজিতে নিরুৎসাহিত করবে যেকোনো প্রতারণা করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রাক্কালে।

মেজবাউদ্দিন মো. জীবন চৌধুরী
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও, আহকাম এন্ড অ্যাসোসিয়েটস বিজনেস লিমিটেড
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ট্যাক্সসেন্স লিমিটেড

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *