আফ্রিকার দেশগুলোতে বিপুল পরিমাণে ঋণ কার্যক্রম চালাচ্ছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন। মূলত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনে চীনের কাছ থেকে এই ঋণ নিচ্ছে আফ্রিকার দেশগুলো। আর বেইজিংয়ের এই ঋণ কর্মকাণ্ডে উদ্বিগ্ন বিশ্বব্যাংক।
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট নিজেই এই তথ্য সামনে এনেছেন বলে রোববার (২ এপ্রিল) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফ্রিকার উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোকে চীন যে ঋণ দিচ্ছে তার কিছু বিষয় নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন বলে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস বিবিসিকে বলেছেন। তিনি বলেছেন, ঋণ প্রদানের এসব শর্তাবলী ‘আরও স্বচ্ছ’ হওয়া দরকার।
বিবিসি বলছে, ঘানা এবং জাম্বিয়াসহ আফ্রিকার দেশগুলো বেইজিংয়ের কাছ থেকে তাদের নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে লড়াই করছে বলে বিদ্যমান গুঞ্জনের মধ্যেই বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট নিজের উদ্বেগের কথা সামনে আনলেন। যদিও চীন বলেছে, এই ধরনের ঋণ আন্তর্জাতিক নিয়মের মধ্যেই প্রধান করা হয়ে থাকে।
অবকাঠামো, শিক্ষা এবং কৃষির বিকাশ-সহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রায়শই অন্যান্য দেশ বা আর্থিকখাতের বহুপাক্ষিক সংস্থার কাছ থেকে অর্থ ধার করে থাকে। কিন্তু গত বছর যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোতে সুদের হারের তীব্র বৃদ্ধি এসব উন্নয়নশীল দেশের ঋণ পরিশোধকে আরও ব্যয়বহুল করে তুলছে।
কারণ এসব ঋণের বিপুল পরিমাণ মার্কিন ডলার বা ইউরোর মতো বিদেশি মুদ্রায় পরিশোধ করা হয়। আর এটিই উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য তীব্র সমস্যা সৃষ্টি করেছে। কারণ এসব দেশের নিজস্ব মুদ্রার আপেক্ষিক মূল্য হ্রাসের সাথে সাথে প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত অর্থ খুঁজে পেতে কার্যত সংগ্রাম করছে তারা।
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস বলেছেন, এই ধরনের বিষয়গুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অনেকটা ‘দ্বৈত ধাক্কা এবং এর মানে হলো- এসব দেশের (অর্থনৈতিক) প্রবৃদ্ধি ধীর হতে চলেছে’।
বিবিসি বলছে, এই সপ্তাহে মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস আফ্রিকার তিনটি দেশে সফর করেন। তার এই সফরের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল এই ধরনের ঋণের পরিণতি এবং এর জেরে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। এছাড়া কমলা হ্যারিসের এই সফরে আর্থিক সহায়তার বড় প্রতিশ্রুতিও পেয়েছে তানজানিয়া এবং ঘানা।
মূলত আফ্রিকা মহাদেশে প্রভাব বিস্তারের জন্য চীনের সাথে ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এছাড়া আফ্রিকার প্রাচুর্যময় প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে নিকেলের মতো ধাতু, যেটি বৈদ্যুতিক গাড়ির মতো প্রযুক্তির প্রয়োজনীয় ব্যাটারির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ঘানার রাজধানী আক্রাতে বক্তৃতাকালে কমলা হ্যারিস বলেন, ‘আমাদের আফ্রিকান অংশীদারদের জন্য আমরা কী করতে পারি তার মাধ্যমে আমেরিকা পরিচালিত হবে না, বরং আমরা আমাদের আফ্রিকান অংশীদারদের সাথে কী করতে পারি (সেটির মাধ্যমেই ওয়াশিংটন পরিচালিত হবে)।
এছাড়া তানজানিয়ায় নতুন একটি নিকেল প্রক্রিয়াকরণ অবকাঠামো নিয়ে কথা বলার সময় হ্যারিস বলেন, এই প্রকল্পটি ২০২৬ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য বাজারে পণ্য সরবরাহ করবে এবং এটি ‘জলবায়ু সংকট মোকাবিলা করতে, বিশ্বব্যাপী স্থিতিস্থাপক সরবরাহ চেইন তৈরি করতে এবং নতুন শিল্প ও চাকরি তৈরি করতে সহায়তা করবে’।
বিবিসি বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই সহযোগিতামূলক পদক্ষেপের প্রশংসা করেন ডেভিড ম্যালপাস। তিনি বলেন, বিশ্বের বৃহত্তম দু’টি অর্থনীতির মধ্যে এই প্রতিযোগিতা ‘উন্নয়নশীল দেশগুলো জন্য সম্ভবত ভালো’, কারণ এই ধরনের প্রতিযোগিতা দেশগুলোর জন্য বিভিন্ন বিকল্প সামনে আনে।
ডেভিড ম্যালপাস বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে যা উৎসাহিত করি তা হলো- চুক্তির স্বচ্ছতা। অর্থাৎ ঋণ আদান-প্রদানের সময় তারা যেন তাদের চুক্তিতে স্বচ্ছ থাকে। ঋণ প্রদানের জন্য যদি আপনি কোনও চুক্তি লেখেন, আর সেখানে যদি লিখে দেওয়া হয়, ‘এটি অন্য কাউকে দেখাবেন না’, তাহলে এটি একটি সমস্যা। এটি বাদ দিতে হবে। তাই এটি থেকে দূরে সরে যান।’
বেইজিং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর ঋণের সবচেয়ে বড় উৎস হয়ে উঠেছে। কিয়েল ইনস্টিটিউট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমির নেতৃত্বে হওয়া নতুন এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে চীন বিশ্বব্যাপী ২২টি দেশকে ১৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জরুরি বেলআউট অর্থ ধার দিয়েছে।
অবশ্য আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে অন্যান্য দেশকে শোষণ করার বিষয়ে যে অভিযোগ সামনে এসেছে, চীন তা বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।
চলতি সপ্তাহে এক সংবাদ সম্মেলনে বেইজিংয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং বলেন, চীন (ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে) ‘সংশ্লিষ্ট দেশের ইচ্ছাকে সম্মান করে, কোনও পক্ষকে কখনোই অর্থ ধার নিতে বাধ্য করেনি, কোনও দেশকে কখনোই অর্থ পরিশোধ করতেও বাধ্য করেনি। এমনকি ঋণ চুক্তিতে কোনো রাজনৈতিক শর্ত সংযুক্ত করে না চীন। এছাড়া ঋণ প্রদানের মাধ্যমে কোনও রাজনৈতিক স্বার্থ কামনা করি না আমরা।’