আফগানিস্তানে নারী ও মেয়েদের লক্ষ্য করে ক্ষমতাসীন তালিবান সরকারের নিষেধাজ্ঞায় বেশ জোরালো প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটি আফগানিস্তানে কিছু কর্মসূচি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে এবং অন্যান্য অনেক কার্যক্রমও স্থগিত করার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে।
গত সপ্তাহে তালেবান গোষ্ঠী আফগান নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া এবং বেসরকারি সংস্থায় (এনজিও) কাজ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। আর এরপরই এই সিদ্ধান্ত জানাল জাতিসংঘ। বৃহম্পতিবার (২৯ ডিসেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ বুধবার বলেছে, আফগানিস্তানে কিছু ‘সময়-গুরুত্বপূর্ণ’ প্রোগ্রাম সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। একইসঙ্গে নারী সহায়তা কর্মীদের ওপর তালেবান নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটিতে অন্যান্য অনেক কার্যক্রমও স্থগিত করতে হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছে সংস্থাটি।
জাতিসংঘের সাহায্য প্রধান মার্টিন গ্রিফিথস, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রধান এবং বিভিন্ন সাহায্য গোষ্ঠী এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, ‘সাহায্য বিতরণে নারীদের অংশগ্রহণ (বন্ধ করা) আলোচনার যোগ্য নয় এবং এটি চালিয়ে যেতে হবে।’
বিবৃতিতে তালেবান কর্তৃপক্ষকে নারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহার করার আহ্বানও জানানো হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, ‘নারীদের মানবিক কাজ থেকে নিষিদ্ধ করার ফলে সকল আফগানের জন্য তাৎক্ষণিক জীবন-হুমকির পরিণতি সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যেই নারী কর্মী সংকটের কারণে কিছু সময়-গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রাম সাময়িকভাবে বন্ধ করতে হয়েছে।’
‘মানবিক সম্প্রদায় হিসাবে আমরা আমাদের পরিচালন সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতাগুলোকে উপেক্ষা করতে পারি না। আমরা জীবন রক্ষা, সময়-গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব ... তবে আমরা আশঙ্কা করছি, অনেক কার্যক্রম হয়তো আমাদের থামাতে হবে কারণ আমরা নারী সাহায্য কর্মীদের ছাড়া মানবিক সহায়তা নীতিগতভাবে দিতে পারি না।’
এর আগে গত শনিবার ইসলামপন্থি তালেবান নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের পক্ষ থেকে নারী ত্রাণকর্মীদের ওপর নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেওয়া হয়। এর আগে গত সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বিষয়ে নারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। আর এরও আগে গত মার্চ মাসে মেয়েদের হাইস্কুলে যাওয়া বন্ধ করা হয়েছিল।
ইউনিসেফ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি এবং জাতিসংঘের শরণার্থী ও মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারদের স্বাক্ষরিত এই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘কোনো দেশই তার জনসংখ্যার অর্ধেককে সমাজে অবদান রাখা থেকে বাদ দিতে পারে না।’
এদিকে পৃথকভাবে আরও ১২টি দেশ এবং ইইউ যৌথভাবে নারী সাহায্য কর্মীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে এবং নারী ও মেয়েদের স্কুলে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য তালেবানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ-এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এই বিবৃতি জারি করেছেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নারী সাহায্য কর্মীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা ‘লাখ লাখ আফগানদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে, কারণ এসব মানুষ বেঁচে থাকার জন্য মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।’
এছাড়া লাখ লাখ আফগানের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া চারটি বড় বৈশ্বিক গোষ্ঠী গত রোববার বলেছে, তারা আফগানিস্তানে তাদের অপারেশন স্থগিত করছে। কারণ নারী কর্মীদের ছাড়া তারা তাদের প্রোগ্রাম চালাতে সক্ষম নয়।
জাতিসংঘের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নারী সাহায্য কর্মীদের ওপর তালেবানের নিষেধাজ্ঞা ‘এমন সময়ে আরোপ করা হলো যখন আফগানিস্তানের ২৮ মিলিয়নেরও বেশি লোকের ... বেঁচে থাকার জন্য সহায়তা প্রয়োজন। কারণ তালেবানশাসিত এই দেশটি দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক সংকট, দারিদ্র্য এবং নিষ্ঠুর শীতের ঝুঁকির সঙ্গে লড়াই করছে।’
জাতিসংঘের সংস্থা এবং সাহায্য গোষ্ঠীগুলো আফগানিস্তানের সকল নারী, পুরুষ এবং শিশুদের স্বাধীন, নীতিগত, জীবন রক্ষাকারী সহায়তা প্রদানের জন্য তাদের প্রতিশ্রুতিতে অবিচল থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে ওয়ার্ল্ড ভিশন ইন্টারন্যাশনাল, কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল, সেভ দ্য চিলড্রেন ইউএস, মার্সি কর্পস অ্যান্ড ইন্টারঅ্যাকশন।
উল্লেখ্য, ২০ বছর পর গত বছরের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান দখলে নেয় তালেবান। এরপর সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে তালেবান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার ঘোষণা দেয়। অবশ্য সরকার গঠন করলেও বিশ্বের কোনো দেশই এখনও পর্যন্ত তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি।